Friday,27 Oct 2017
Ctgbarta24.com
প্রায় ১০ বছর আগের কথা। দিন তারিখ মনে নেই, খুঁজে বের করতে হবে। ২০০৭ সালের আগস্ট হবে।দিন তারিখ গল্পটিতে প্রাসংগিক নয়। আমি তখন কেবল প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছি। নবীন বরণে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে পা রাখার অনুভূতি বিষয়ক একটা বক্তব্যও রেখে ফেললাম। ক্যাম্পাসের আকাশে বাতাসে শুধুই স্বাধীনতার ফুরফুরে প্রবাহ; এক অদ্ভুত ভয়হীন টুকরো ভূখন্ড। সারাদিন এই স্বাধীনতার হাওয়ায় ভেসে বেড়িয়েছি।যেদিনের কথা লিখছি সেদিন আমাদের ডিপার্টমেন্টের সাথে কোন এক ডিপার্টমেন্টের, সম্ভবত ইতিহাস,আন্ত:ডিপার্টমেন্ট ফুটবলের সেমিফাইনাল খেলা। মাঠে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। টিএসসি থেকে বের হয়ে দেখি টিএসসি থেকে দোয়েল চত্ত্বরের রাস্তায় শত শত ছাত্রছাত্রীর মিছিল। একেবারেই কাউকে কিছু না বলে। তখনো বুঝে উঠতে পারিনি ইতিহাস চোখের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। সময়টা স্বাভাবিক ছিল না। আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বেগম জিয়া তখন জেলে। রাজনীতির সব ঋতুই বসন্ত নয়। তবে রাজনীতির সিংহভাগ কোকিলই বসন্তের। দুই নেত্রী জেলে। রাস্তায় কোন নেতা-কর্মী নেই; এত সব ত্যাগী রাজপথের লড়াকু সৈনিকেরা সব ব্যারাকে। নেতা কর্মী কারো মুখেই কোন কথা নেই। সাড়াশব্দও নেই।দিনশেষে, ভয়ের শক্তি যেকোন শক্তির চেয়ে বড় ।
যাই হোক, আমাদের জিমনেশিয়াম মাঠের এক কোণায় বসেছে সেনাবাহিনী ক্যাম্প। সেই খেলার মাঠে দর্শকসারিতে বসা আমাদের একজন ছাত্রকে সেনাবাহিনী তুচ্ছ কারণে খুব মারল। । এর প্রতিবাদেই রাস্তায় শত শত সাধারণ ছাত্রছাত্রী। এতটাই ভয়শূন্য একদল মেধাবী তরুণ যে সারাদেশের শত শত দলীয় নেতাকর্মী যেখানে রাতারাতি নিরপেক্ষ হয়ে গিয়েছে; সন্ধ্যা বেলা ভদ্র সুবোধের মত বাড়ি ফিরে সংসারে ডুব দিচ্ছে; তখন আমরা রাস্তায়। প্রথম বর্ষের একেবারেই নবাগত শিক্ষার্থী আমি তখন। রাজনীতি বুঝি না; কিন্তু ন্যায় অন্যায় সম্ভবত বুঝতে পারি। আমি তৃতীয় বর্ষের তানিয়া আপু, মাস্টার্সের রিয়াদ ভাইসহ সিনিয়রদের জানালাম ডিপার্টমেন্ট বন্ধ ঘোষণাসহ তীব্র কর্মসূচির কথা। রাতজেগে বড় বড় প্ল্যাকার্ড লিখে বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে পরদিন সকালে ডিপার্টমেন্টে হাজির। ডিপার্টমেন্টে তখন ঝুলছে তালা । আমরা কোনক্রমেই তালা খুলতে দিব না। সকালে চেয়ারম্যান স্যার তালা খুলে শুধু গবেষণা কর্মের জন্য ভেতরে যেতে চাইলেন আমাদের দাবি দাওয়ার প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেই। কার্জন হল জুড়ে পোস্টার লাগিয়ে দিলাম -প্রতিবাদের রাতজাগা পোস্টার। আমাদের পোস্টারে প্রধান প্রধান দাবি ছিল:
১) সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করতে হবে
২) ঘটনার বিচার করতে হবে
৩) সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে
বিশ্ববিদ্যালয় তখন দাউদাউ করে জ্বলছে; মিছিল- মিটিং-আন্দোলনের ছোঁয়াচে অগ্নিশিখায়! আমরাও নিজ নিজ বিভাগে দ্রোহের সেই মশাল জ্বালিয়ে রাত পোহাচ্ছি। ভোর হওয়া পর্যন্ত জেগে থাকার প্রত্যয়ে। পুরো আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন আমাদের ডিপার্টমেন্টের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রফেসর ড. মো: আনোয়ার হোসেন (জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন পরে)। ক্রমেই আন্দোলনটি আমাদের সাধারণ শিক্ষার্থীর আন্দোলন থেকে দেশের প্রধানতম রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। আন্দোলনের তিন দিনের মাথায় (সম্ভবত) ঢাকা শহর জুড়ে কার্ফিউ জারি করা হল। হল ছেড়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের নির্দেশ প্রদান করা হল। আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। গুম, ভয়,অপহরণ আর গ্রেপ্তারে এই আন্দোলন নিভে যাবার শঙ্কা থাকলেও এটি আর কখনোই নেভেনি। রাজনৈতিক দলগুলো উপলব্ধি করল বেয়নেট, কামান, ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়েও মুক্তির স্লোগান দেওয়া যায়; ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় হাসিমুখে মরে যাওয়া যায়। বরাবরের মতই এ বারেও পাঞ্জেরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই আন্দোলনে আমার আর কোন স্মৃতি নেই বা থাকলেও লিখছি না। তবে একটা বিষয় বুঝে গিয়েছিলাম- অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন প্রতিরোধের আরেক নাম স্বাধীনতা ! বিশ্ববিদ্যালয় যেন স্বাধীনতার পূণ্যভূমি। চিত্ত যদি কখনো ভয়শূন্য থাকে তবে সেটি বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিল; শাহবাগ থেকে চাংখারপুল; হাইকোর্ট থেকে নীলক্ষেত। মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সাম্যের প্রতি অনুরাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতির অংশ ছিল।
এর অনেক পরে ২০১১ সালের জুলাই মাসের ঘটনা।আমাদের ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাই -কাদের ভাই। হঠাৎ শুনলাম; ওসি হেলাল ( খিলগাঁও থানা) তাকে রাত দুইটার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় দেওয়ার পরও থানায় নিয়ে যায় ডাকাত সন্দেহে। নিয়ে যাওয়ার পর ওসি একটি চাপাতির ধার কত- এই জাতীয় পরীক্ষা চালিয়েছিল কাদের ভাইয়ের পায়ের পর। ফলাফল কাদের ভাইয়ের সাময়িক পঙুত্ব। প্রত্যাশিতভাবেই কাদের ভাইকে পুলিশ ছিনতাইকারী সাজানোর চেষ্টা করে (বহুল পরিচিত স্ট্র্যাটেজি) এবং ছিনতাই, ডাকাতি ও অস্ত্র মামলা দেয়। আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল একটি মানববন্ধনের মাধ্যমে; অপরাজেয় বাংলার সামনে। পরবর্তীতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করে আমরা স্মারকলিপিসহ আরেফিন সিদ্দিক স্যারের কাছে যাই। দাবি ছিল ন্যায় বিচার, মামলা প্রত্যাহার ও ওসি হেলালের দম্ভ ও অত্যাচারের দৃষ্টান্তমূলক বিচার। সেখানে শিক্ষার্থীদের একজন প্রতিনিধি হিসেবে স্যারের সাথে ভিতরে গিয়ে কথা বলেছিলাম আমি। স্যার বলেছিলেন, “পুলিশ তাকে এমন করার কারণ কি বল তো?”
জবাবে আমি বলেছিলাম; ” দেশে কি হয়, আপনি কি তা জানেন না স্যার?”
একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর ভিসির সাথে বলা এই বাক্যই বলে দেয় মত প্রকাশে কি নি:সংকোচ ছিলাম আমরা।এতটাই ভয়শূন্য ও আপোষহীনভাবে কথা বলতে পারতাম আমরা আমাদের প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুধু আমি নই, প্রায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটাদাগে এই অধিকারটুকু চর্চা করে। কি সাধারণ কি রাজনৈতিক!
” চিত্ত যেখানে ভয়শূন্য ” কবিতার লাইনটি যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই রচিত। এরপর
একটি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে। আমাদের আন্দোলন, প্রথম আলোসহ মিডিয়ার সাপোর্ট, আনোয়ার স্যার ও প্রাক্তন আইনমন্ত্রী জনাব আব্দুল মতিন খসরুর চেষ্টায় আমরা বিচার পেয়েছিলাম। ওসি হেলাল বরখাস্ত হয়েছিল; মামলা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে ও পরবর্তীতে তিনি তিন বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে এতটাই ক্ষমতায়িত অনুভব করতাম আমরা। সামাজিক বিচার প্রতিষ্ঠায় ও বিচার পাওয়ার অধিকারের সঠিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক প্রকান্ড বটবৃক্ষ। এই বটবৃক্ষ সামাজিক ন্যায়বিচারকে ছায়া দিয়ে লালন করে। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠণ জ্ঞানভিত্তিক সমাজের চেয়েও বেশি জরুরি। সমাজে শুধু শিক্ষার আলো নিশ্চিত করলেই অন্য সব অন্ধকার পালিয়ে যায় না। শিক্ষার আলোর নিচেই অত্যাচার, অন্যায় আর অবিচারের অন্ধকার নির্বিঘ্নে দম্ভভরে বসবাস করতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভবত ভেঙেছে। প্রথা, ঐতিহ্য, রীতিনীতি সবকিছুই ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে যায়; বিবর্তনের স্পর্শে পরিবর্তিত হয়। অনেক কিছুই হয়তোবা ঠিক হয়নি; অনেক ঘটনার দায়ই হয়তোবা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির স্বর্ণযুগ বিগত হয়েছে। এই দীনতা; এই অবক্ষয়ের সবটুকু স্বীকার করেই লিখতে চাইছি:
সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ম্যান্ডেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জন্মলগ্ন থেকেই ন্যায় বিচারে আপোষহীন পথচলার দীক্ষা দিয়ে আসছে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ডিপার্টমেন্টেরই সিলেবাস বা পুস্তকে নেই। এটি ছড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তার ইতিহাস ধারণের প্রতিদিনে, ভাস্কর্যগুলোর অপ্রকাশিত চেতনায়, শত বছরের পুরনো গাছগুলোর সবুজ লালনের কৃষ্টিতে।এটি আলো হয়ে ছড়িয়ে আছে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে। এখানেই শিখেছিলাম কিভাবে কালবোশেখির মাঝেও দ্রোহের মশাল আগলে রাখতে হয়; কিভাবে স্রোতের বিপরীতে হাসিমুখে নৌকা বাইতে হয়!
সোহেল রানা
নির্বাহী ম্যাজিসট্রেট
(লেখকের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত )









